টাকের কাছে চিরুনি যেমন সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন, তেমনি অন্ধের কাছে আয়নাও ততটাই অপ্রয়োজনীয়। আয়নাটি যতই উৎকৃষ্ট গুণাবলিসম্পন্ন হোক না কেন, দৃষ্টিহীন মানুষের কাছে তার কোনো কার্যকর মূল্য নেই। অন্ধের কাছে আয়নার চেয়ে বহুগুণ বেশি প্রয়োজনীয় একটি সাদা ছড়ি—যার সাহায্যে সে কারো কাঁধে ভর না দিয়েই নিরাপদে পথ চলতে পারে, রাস্তা পার হতে পারে এবং নিজের গন্তব্য খুঁজে নিতে পারে।

এই বাস্তবতা উপলব্ধি করলে সহজেই বোঝা যায়—যে দেশে অধিকাংশ মানুষ অন্ধ, সে দেশে আয়নার ব্যবসা কখনোই লাভজনক হতে পারে না। এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারলে কেউ কখনো অন্ধের দেশে আয়না বিক্রি করার কথা ভাববে না। কারণ—

প্রথমত, অন্ধের কাছে আয়নার কোনো ব্যবহারিক প্রয়োজন নেই।

দ্বিতীয়ত, আপনি যদি আয়নাটি বিক্রি না করে বিনামূল্যেও অন্ধকে প্রদান করেন, তবুও আপনার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। মানুষ আপনার নিয়তকে সন্দেহের চোখে দেখবে এবং আপনাকে প্রতারক কিংবা ধূর্ত হিসেবে আখ্যায়িত করবে। তারা বলবে—যে জানে অন্ধ চোখে দেখে না, সে জেনেশুনেই তাকে ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আয়না হাতে তুলে দিয়েছে।

তৃতীয়ত, ধরুন—আপনার মহৎ উদ্দেশ্য বুঝে কিংবা অন্য কোনো কারণে অন্ধ ব্যক্তি আয়নাটি গ্রহণ করল। কিন্তু দৃষ্টিহীনতার কারণে অসাবধানতাবশত আয়নাটি ভেঙে সে আহত হলো। তখন আপনার দেওয়া আয়নার ভাঙা কাচই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে আপনাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার জন্য। অভিযোগ উঠবে—আপনি সুপরিকল্পিতভাবে আয়নাটি দিয়েছেন, যাতে কাচ ভেঙে দুর্ঘটনায় অন্ধের মৃত্যু ঘটে এবং আপনি দায় এড়িয়ে যেতে পারেন।

অতএব, কোনো অবস্থাতেই—মনেও—অন্ধের দেশে আয়না বিক্রি করার চিন্তা করা উচিত নয়।

এখন হয়তো মনে হতে পারে—“আমি কি উদ্যোক্তা হয়ে জন্মেছি থেমে যাওয়ার জন্য?” আয়না না হয় বিক্রি করা হলো না। অন্ধদের উপকারের উদ্দেশ্যে এবার সাদা ছড়ির ব্যবসা করা যাক—যাতে তারা এই ছড়ির সাহায্যে কারো ওপর নির্ভর না করেই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে।

ধরা যাক, আপনি অন্ধের দেশে আয়নার পরিবর্তে সাদা ছড়ি সরবরাহ করলেন। অল্প সময়েই আপনার বিক্রি করা ছড়ি সবার হাতে পৌঁছে গেল। কিন্তু হঠাৎ কোনো এক অন্ধ—ছড়ির ঝনঝনানি বা অন্য কোনো তুচ্ছ কারণে—মেজাজ হারিয়ে পাশের আরেক অন্ধের মাথায় আঘাত করল। আঘাতপ্রাপ্ত অন্ধটিও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় তার ছড়ি দিয়ে আঘাত করল অন্যজনকে। এভাবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে অন্ধের দেশের প্রতিটি অন্ধ একে অপরের বিরুদ্ধে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ল।

বিশ্ববাসী তখন দেখল—অন্ধের দেশ গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত গড়াল। সেই আদালতেই গৃহযুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে আপনার সরবরাহ করা সাদা ছড়ি উপস্থাপন করা হলো।

তখন সেই ছড়ির ভগ্নাংশই প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে আপনাকে অপরাধী সাব্যস্ত করার জন্য। অভিযোগ উঠবে—আপনি সুপরিকল্পিতভাবে অন্ধদের হাতে এই ছড়ি তুলে দিয়েছেন, যাতে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে এবং আপনি নেপথ্যে থেকেই দায়মুক্ত থাকেন।


অতএব, শিক্ষা একটাই—

মনের ভুলেও অন্ধের দেশে কোনো ধরনের ব্যবসায় জড়ানো উচিত নয়।